জে. জাহেদ, চট্টগ্রাম প্রতিনিধি:
খোলা তেল কিংবা বোতলজাত তেলে দেশের বাজারের ৭৫ ভাগ সয়াবিন তেলই আগাগোড়া ভেজাল। বিক্রি হচ্ছে নতুন তেল হিসাবে। সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ভেজালবিরোধী তৎপরতার মধ্যেও থেমে নেই অসাধু ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তা চক্র। অপ্রতিরোধ্য দুষ্টচক্র প্রায় সব খাদ্যসামগ্রীতেই ভেজাল দিচ্ছে।
মানহীন কিংবা নিম্নমানের পণ্য দিয়ে ক্রেতা সাধারণের কাছ থেকে হাতিয়ে নিচ্ছে বিপুল পরিমাণ অর্থ। এসব অসাধু ব্যবসায়ী বিষাক্ত রাসায়নিক দ্রব্যের মিশ্রণ ঘটিয়ে সরিষার তেল তৈরি করে থাকে। আর সয়াবিন তেলে ভেজাল হিসেবে মেশানো হচ্ছে পাম তেল, পোড়া মবিল, পশুর চর্বি ও খনিজ তেল।
বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ড অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউট (বিএসটিআই), জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট, চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন ও ভ্রাম্যমাণ আদালত সূত্রে জানা গেছে, বোতলজাত ভোজ্য তেলেও অস্বাস্থ্যকর পদার্থের অস্তিত্ব পাওয়া যাচ্ছে। সম্প্রতি বাজার থেকে সংগৃহীত বিভিন্ন ব্র্যান্ডের কিছু বোতলজাত ও খোলা ভোজ্যতেল সংগ্রহ করে বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা নিরীক্ষায় কয়েকটি ব্র্যান্ডের তেলে কস্টিক সোডা ও বিষাক্ত কেমিক্যালের অস্তিত্ব মিলেছে। আর বাজার থেকে খোলা তেল সংগ্রহ করে তা পরীক্ষা করে দেখা গেছে এ তেলের সিংহভাগই ভেজাল ও খাবারের অনুপযোগী।
এক শ্রেণীর অসাধু ব্যবসায়ী চক্র রান্নার প্রধান উপকরণ ভোজ্যতেলে সাবান তৈরির পাম অয়েল ও বস্ত্রকলের বিভিন্ন কেমিক্যাল মিশ্রণ করে বাজারজাত করছে। এ চক্রগুলো সাবান, বস্ত্রকলসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নামে খনিজ তেল (হোয়াইট অয়েল), সাবান তৈরির পাম অয়েল ও পশুর চর্বি আমদানি করে তা ভোজ্যতেলে মিশ্রণ করছে। এগুলো বাজারে সয়াবিন, বিনো ও পাম তেল হিসেবে বিক্রি হয়। আর এসব তেলে তৈরি খাদ্য আহারে মানবদেহে জটিল ও কঠিন রোগের জন্ম দিচ্ছে।
সেন্টার ফর স্পেশালাইজড কেয়ার এন্ড রিসার্স (সিএসসিআর) এর হাসপাতালের মেডিসিন ও হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ ডাঃ ইব্রাহিম চৌধুরী বলেন, ‘খাদ্যে ভেজালের কারণে মানুষ ১২ থেকে ১৫টি রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। এসব রোগে মানুষের মৃত্যুহার বেড়েছে। ভেজাল ও বিষাক্ত কেমিক্যাল মিশ্রিত ভোজ্যতেল আহারে মানবদেহে জটিল ও কঠিন রোগ সৃষ্টি হয়।
তিনি আরও বলেন, ‘ভোজ্যতেলে ব্যবহার্য বিভিন্ন বিষাক্ত কেমিক্যাল ও সাবান তৈরির কাঁচামাল মানবদেহের অভ্যন্তরে একবার প্রবেশ করলে লিভার দেহ থেকে তা নিষ্কাশন করতে পারে না। আর ভেজাল তেল দিয়ে রান্না খাদ্য সামগ্রী আহারের ফলে নেফ্রাইটিস নামক জটিল কিডনি রোগ হতে পারে। আর এ রোগে আক্রান্তদের হাতে পায়ে পানি জমে ফুলে যায় এবং অল্প সময়ের ব্যবধানে কিডনি অকেজো হওয়ার আশঙ্কা থাকে। এছাড়া হৃদরোগ, ক্যান্সার, লিভার সিরোসিসের মতো প্রাণঘাতী রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।’
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগে প্রভাষক মরিয়ম ইসলাম লিজা জানান, ‘এক ব্যারেল সয়াবিন তেলের মধ্যে ২৫০ গ্রামের এক কৌটা অ্যালাইল আইসো-থায়োসায়ান ইডের মিশ্রণ করলে ওই তেলের গন্ধ ও ঝাঁজ খাঁটি সরিষার তেলের সমান হয়ে যায়। পরে টেক্সটাইলের রং মিশ্রণ ঘটিয়ে হুবহু সরিষার তেলের ন্যায় করা হয়।’
বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস এন্ড টেস্টিং ইন্সটিটিউশন (বিএসটিআই) চট্টগ্রাম অফিসের উপ-পরিচালক (রসায়ন) তাপস মল্লিক বলেন, ‘ভেজাল প্রতিরোধে বিএসটিআই এর ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযান দেশব্যাপী অব্যাহত রয়েছে। তবে ভেজাল প্রতিরোধে বিএসটিআই’র জনবল ও প্রযুক্তিগত উন্নয়ন প্রয়োজন। পাশাপাশি খাদ্যে ভেজালের অপরাধের শাস্তি ও জরিমানার বিধান আরো কঠোর করতে হবে।
জানা গেছে, সম্প্রতি জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের খোলা ও বোতলজাত সয়াবিনের ২৮ টি নমুনা পরীক্ষায় ২১ টিতেই ধরা পড়ে মাত্রাতিরিক্ত ফ্যাটি এ্যাসিড। সঙ্গে ক্ষতিকর রাসায়নিকতো আছেই। তেলের রং স্বচ্ছ বা গাঢ় করার রাসায়নিকও ধরা পড়ে পরীক্ষকের চোখে। তাছাড়া শোধনের নামে যেসব রাসায়নিক ব্যবহার করা হয় সেগুলোও অনুমোদনহীন।
জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের ল্যাবরেটরির কর্মকর্তা ড. মতিউর রহমান বলেন, ‘ভোজ্য তেলের অবস্থা আসলেই খারাপ। মুনাফার জন্য একটা তেল আরেকটার সঙ্গে মেশানো হচ্ছে। এতে তেলের অভ্যন্তরীণ কার্বন চেইনগুলো পরিবর্তন হয়ে যায়। যখন কার্বন বন্ডিং পরিবর্তন হয়, তখন পুরো তেলের চরিত্রই পরিবর্তন হয়ে যায়। এভাবে ভোজ্য তেলের মান পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছে। এটা আমাদের স্বাস্থ্যগত অনেক সমস্যা সৃষ্টি করে।’
অনলাইনে সাড়া জাগানো ডাঃ মো. জাহাঙ্গীর কবির বারবার বলছেন,‘সয়াবিন তেল খাচ্ছি না বিষ খাচ্ছি! সয়াবিন তেল তৈরি হয় ৬০০ থেকে ৭০০ ডিগ্রি তাপমাত্রায়। এত তাপমাত্রায় পোড়ানোতে তেল হয়ে যায় বিষাক্ত। তাপমাত্রা সহনের জন্য মিক্সড করা হয় ক্যামিকেল স্ট্যবিলাইজার। আর সাথে যোগ করা হয় কৃত্রিম রং। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা যায় এমন তেল খাওয়ার কারনেই বৃদ্ধি পাচ্ছে গ্যষ্টিক, আলসার, হৃদরোগসহ অনেক রোগ।
এ পরিস্থিতিতে বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ হচ্ছে, বেশি তাপমাত্রার তেলে কোনো কিছু যেন রান্না না করা হয়। এক তেল বারবার ব্যবহার না করতে পরামর্শ দেন তাঁরা।
পাঠকের মতামত: